ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা হঠাৎ করে ঘটে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে ভবন ধসে পড়া, সেতু ভেঙে যাওয়া এবং ভূমিধসের মতো বিপর্যয় ঘটতে পারে। এটি সাধারণত টেকটোনিক প্লেটগুলির সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট হয় এবং এর তীব্রতা ও সময়কাল ভিন্ন হতে পারে।
বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ, যেখানে বিভিন্ন সময় মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বিশেষ করে, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। অতএব, ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে। তাই ভূমিকম্পের সময় আপনার প্রতিক্রিয়া যত দ্রুত ও সঠিক হবে, ততই আপনি ও আপনার পরিবার নিরাপদে থাকতে পারবেন। আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধরে সঠিক কৌশল অনুসরণ করা প্রয়োজন।
এই নিবন্ধে, আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় এবং কীভাবে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। সচেতনতা ও প্রস্তুতিই পারে একটি বড় বিপর্যয়কে ছোট করে ফেলতে।
ভূমিকম্পের সময় করণীয়
ঘরের ভেতরে থাকাকালীন করণীয়
যদি ভূমিকম্পের সময় আপনি ঘরের ভেতরে থাকেন, তাহলে দ্রুত এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্কিত হলে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা আপনাকে আরও বিপদে ফেলতে পারে। ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থির থাকুন এবং দ্রুত নিরাপদ আশ্রয় খুঁজুন।
সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, শক্ত কোনো আসবাবপত্র যেমন টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কাঠের বিছানার নিচে আশ্রয় নেওয়া। যদি এরকম কিছু না থাকে, তবে দেয়ালের পাশের কোনো শক্ত কোণে বসে পড়ুন এবং হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন। ভূমিকম্পের সময় জানালা, আয়না, ভারী আসবাবপত্র এবং ঝুলন্ত বস্তু থেকে দূরে থাকুন, কারণ এগুলো সহজেই ভেঙে পড়তে পারে।
অনেকেই ভূমিকম্পের সময় দরজা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করেন, যা একটি ভুল ধারণা। ভূমিকম্পের সময় দরজা সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হতে পারে, কারণ এটি ধসে পড়তে পারে বা দরজার ফ্রেম দুর্বল হলে সহজেই ভেঙে যেতে পারে। একইভাবে, রান্নাঘরে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন, কারণ রান্নাঘর হলো গ্যাস লিকেজ ও আগুন লাগার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান।
যদি ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ সংযোগ চালু থাকে, তাহলে লাইট বন্ধ করুন এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন। তবে, যদি আগুন দেখা যায়, তাহলে দ্রুত গ্যাস লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করার চেষ্টা করুন, কিন্তু শুধুমাত্র যদি এটি নিরাপদ হয়।
ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে জানা থাকলে বিপদের মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। ঘরের ভেতরে থাকলে আতঙ্কিত না হয়ে শক্ত আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন, জানালা ও ভারী বস্তু থেকে দূরে থাকুন এবং বিদ্যুৎ বা গ্যাস লিক হলে দ্রুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন।
ঘরের বাইরে থাকাকালীন করণীয়
যদি ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে জানা থাকে, তাহলে ঘরের বাইরে থাকাকালীনও আপনি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন। ভূমিকম্প শুরু হলে খোলা জায়গায় থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ, তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে বড় বিপদের সম্মুখীন হওয়া সম্ভব।
প্রথমেই, বড় ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছপালা, বিলবোর্ড, ওভারব্রিজ বা অন্য কোনো উঁচু কাঠামো থেকে দূরে সরে যান। কারণ ভূমিকম্পের কারণে এসব কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে এবং মারাত্মক আঘাতের কারণ হতে পারে। খোলা মাঠ, পার্ক বা রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করাই নিরাপদ বিকল্প। তবে, যদি আপনার আশপাশে খোলা স্থান না থাকে, তাহলে শক্ত দেয়ালের কাছাকাছি গিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করুন।
গাড়িতে থাকলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে গাড়ি থামিয়ে সেটার ভেতরে থাকুন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, গাড়ি যেন কোনো উঁচু ব্রিজ, ফ্লাইওভার বা বিল্ডিংয়ের নিচে না থাকে। ভূমিকম্পের কম্পন শেষ না হওয়া পর্যন্ত জানালা বন্ধ রেখে ভেতরেই অবস্থান করা উত্তম।
জনসমাগম এলাকায় থাকলে আতঙ্ক সৃষ্টি করবেন না এবং অন্যদেরও শান্ত থাকতে উৎসাহিত করুন। দৌড়াদৌড়ি বা হুড়োহুড়ি করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। মানুষের ভিড় থেকে দূরে সরে যাওয়া ভালো, কারণ আতঙ্কিত জনতা হঠাৎ করে যেকোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
ভূমিকম্পের সময় চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) বা লিফট ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। তাই ভূমিকম্প শুরু হলে দ্রুত সিঁড়ি থেকে সরে যান এবং সম্ভব হলে স্থির কোনো স্থানে অবস্থান করুন। লিফটের মধ্যে থাকলে প্রতিটি তলার বোতাম চাপুন এবং যত দ্রুত সম্ভব বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন।
ভূমিকম্পের পর করণীয়
ভূমিকম্প শেষ হয়ে গেলেও ঝুঁকি পুরোপুরি কেটে যায় না। আফটারশক বা ছোট ছোট কম্পন প্রায়ই বড় ভূমিকম্পের পরপরই ঘটে, যা আবারও বিপজ্জনক হতে পারে। তাই ভূমিকম্পের পরেও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে জানা থাকলে যেমন আপনি বিপদের সময় সঠিকভাবে কাজ করতে পারবেন, তেমনই ভূমিকম্পের পর কী করতে হবে, সেটাও জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আফটারশকের জন্য প্রস্তুত থাকুন
ভূমিকম্পের পর সাধারণত বেশ কয়েকটি ছোট কম্পন (আফটারশক) অনুভূত হয়, যা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক দিন বা সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তাই আপনার চারপাশ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করুন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবন বা দুর্বল কাঠামোর আশেপাশে অবস্থান করবেন না।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষা করুন
ভূমিকম্পের কারণে গ্যাস পাইপ ফেটে যেতে পারে এবং বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে আগুন লাগার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। গ্যাসের গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে মেইন সুইচ বন্ধ করুন এবং বৈদ্যুতিক সংযোগের সমস্যা থাকলে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
আহতদের সাহায্য করুন
যদি কেউ আহত হয়ে থাকে, তাহলে প্রথমে তার প্রাথমিক চিকিৎসা করুন। গুরুতর আহতদের ক্ষেত্রে চিকিৎসক বা জরুরি সেবার জন্য সাহায্য চান। তবে, যদি ভবন বা ধ্বংসস্তূপের নিচে কেউ আটকে থাকে, তাহলে নিজের জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে উদ্ধারকর্মীদের খবর দিন।
নিরাপদ স্থানে যান
ভূমিকম্পের কারণে ভবন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, তাই দয়া করে ভবনে ফিরে যাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের অনুমতি নিন। যদি কোনো বিল্ডিং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব তা খালি করুন এবং নিরাপদ স্থানে যান।
পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করুন
ভূমিকম্পের পর মোবাইল নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই একাধিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবস্থা রাখুন। পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন।
সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করুন
রেডিও, টেলিভিশন, অথবা সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে আপডেট রাখুন। কখনও গুজবে কান দেবেন না এবং শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা উচিত কি?
না, ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভূমিকম্পের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং লিফট মাঝপথে আটকে যেতে পারে। পরিবর্তে, যদি সম্ভব হয়, সিঁড়ি ব্যবহার করে নিরাপদ স্থানে চলে যান। যদি আপনি লিফটের মধ্যে থাকেন, তাহলে প্রতিটি তলার বোতাম চাপুন এবং যত দ্রুত সম্ভব বের হওয়ার চেষ্টা করুন।
ভূমিকম্পের সময় গাড়ি চালানো নিরাপদ কি?
ভূমিকম্পের সময় চলন্ত গাড়ি চালানো বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ রাস্তার ফাটল, গাছ পড়ে যাওয়া বা সেতু ধসে পড়ার ঝুঁকি থাকে। তাই দ্রুত খোলা এবং নিরাপদ স্থানে গাড়ি থামিয়ে দিন, তবে গাছ, বিল্ডিং বা বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে থাকুন। কম্পন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে থাকাই শ্রেয়।
ভূমিকম্পের সময় যদি ভবনে আটকে পড়ি তাহলে কী করবো?
প্রথমেই আতঙ্কিত হবেন না। যদি আপনি ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে যান, তাহলে উচ্চস্বরে চিৎকার না করে শক্তি সংরক্ষণ করুন। পরিবর্তে, পাইপ বা দেয়ালে ধাক্কা দিন অথবা মোবাইল ফোন থাকলে জরুরি নম্বরে কল করার চেষ্টা করুন। ধুলা এড়ানোর জন্য মুখ ঢেকে রাখুন এবং অপেক্ষা করুন যতক্ষণ না কেউ উদ্ধার করতে আসে।
ভূমিকম্পের সময় কোথায় আশ্রয় নেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ?
ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা সবচেয়ে নিরাপদ। তবে, যদি আপনি ঘরের ভেতরে থাকেন, তাহলে শক্ত আসবাবপত্র যেমন টেবিল বা ডেস্কের নিচে আশ্রয় নিন এবং মাথা ও ঘাড় হাত দিয়ে ঢেকে রাখুন। যদি বাইরে থাকেন, তাহলে গাছ, বিল্ডিং, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ওভারব্রিজ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
উপসংহার
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা আমাদের হাতে নেই, তবে পূর্বপ্রস্তুতি ও সচেতনতা আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে। আপনি যদি ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন, তাহলে বিপদের মুহূর্তে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রাণহানির ঝুঁকি কমে যায় এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও সীমিত রাখা সম্ভব হয়।
ভূমিকম্পের সময় ঘরের ভেতরে থাকলে শক্ত কোনো আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নেওয়া, জানালা ও ভারী বস্তু থেকে দূরে থাকা এবং আতঙ্কিত না হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে থাকলে ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও বড় গাছপালা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। ভূমিকম্পের পরপরই গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষা করা, আফটারশকের জন্য সতর্ক থাকা এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসরণ করা আবশ্যক।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আপনার পরিবার ও সহকর্মীদের ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত করা এবং জরুরি পরিস্থিতির জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, প্রতিটি পরিবারে একটি জরুরি কিট থাকা উচিত এবং ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত তা সবার জানা থাকা আবশ্যক।